বাংলার চলচ্চিত্র
“Cinema’s characteristic forte is its ability to capture and communicate the intimacies of the human mind.”
-Satyajit Ray
সত্যজিৎ রায়, এক যুগান্তকারী চলচ্চিত্র নির্মাতা, যার পানে গোটা বিশ্ব চেয়ে থাকে।
যেই বাংলার মাটি এক সময় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃনাল সেন নামক বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালক আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, যারা তাদের প্রতিটি সিনেমার দ্বারা সমাজ কে কিছু নতুন বার্তা দেয়ার প্রয়াস করতেন, আজ সেই বাংলার পরিচালকরা তাহলে, শুধুই ‘ড্রয়িং রুম’ এ বসে এক পরিবারের গল্প বলার পথে কেন নেমেছে?
হয়তো মানুষ সেটাই দেখতে চায়। হয়তো।
কিন্তু, ঠিক এরই মধ্যে বেরিয়ে আসে কিছু অভূতপূর্ব সিনেমা যা দর্শককে ফের ভাবিয়ে তোলে।
২০১০ সালের পর দেখা গেছে এক গুচ্ছ প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা, যারা নিয়ে এসেছিলেন তাদের সাথে এক গুচ্ছ নতুন গল্প। তারপর ২০১৭, আবির্ভাব হলো ‘OTT’-র, বাংলায় ‘Hoichoi’-এর হাত ধরে শুরু হলো ওয়েবসিরিজ এর চলন।
তাহলে চলুন দেখা যাক ২০১০ সালের পর থেকে পাঁচটা বাংলা সিনেমা এবং ওয়েবসিরিজ যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক নক্ষত্র হয়ে থেকে যাবে
২২শে শ্রাবণ
(সৃজিত মুখার্জী)
একটা ঝড় এসেছিলো বাংলা সিনেমাতে ২০১০ সালে, সিনেমার নাম ‘Autograph’, পরিচালক সৃজিত মুখার্জী। তার প্রথম সিনেমা মানুষ এতটাই পছন্দ করবে, হয়তো সেটা তিনি নিজেও আশা করেননি। কিন্তু তারপর তিনি নিয়ে আসেন ‘২২শে শ্রাবণ’। তিনি খুব ভালো ভাবে রপ্ত করে ফেলেছিলেন কিভাবে একটা ভালো গল্পকে commercial মোড়কে সাজিয়ে দর্শককে উপহার দিতে হয়, আর তার জ্বলজ্বল করা প্রস্তুতি ছিল ২২শে শ্রাবণ। মানুষ প্রথম বার বুম্বাদার মতো এক সুপারস্টার এর মুখে ‘সেই’ ভাষা শুনে হয়েছিলেন হতবাক। কিন্তু ঠিক এইভাবেই সাধারণ মানুষ কথা বলে তাই কিনা? আর এই কারণেই হয়েছিল এই সিনেমা ব্লকবাস্টার।
তার সাথে ছিল অসাধারণ এক অভিনেতার দল আর সেই অনুপম রায় এর গান, এমন খুব কম সংখক মানুষ ছিলেন হয়তো যারা সেই বছর ‘একবার বল’ গানটা একা ঘরে বসে শোনেননি ।
যদি ‘Autograph’ হয়ে থাকে সৃজিত মুখার্জীর বাংলা সিনেমা জগতে জন্ম, ২২শে শ্রাবণ তাকে টলিউডের সুপারস্টার পরিচালক করে তলে।
আশা যাওয়ার মাঝে
(আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত)
একটি Short Story ‘Adventures of A Married Couple’ থেকে অনুপ্রাণিত এই সিনেমা, মুভি ক্রিটিক্স দের করেছিল অবাক। পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, ২০০৮-০৯ সালের কলকাতা তুলে ধরেছিলেন গল্পে। সিনেমায় ছিল দু-জন দক্ষ অভিনেতা, ছিল অসাধারণ এক আবহ সংগীত, ছিল কিছু পুরোনো বাংলা গান এবং দারুন রূপকের ব্যবহার, কিন্তু ছিল না সংলাপ।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন সিনেমাতে কোনো সংলাপ ছিল না।
গল্পে, বৌ চাকরি করে দিনের বেলা, আর স্বামী রাতে, তাদের মধ্যে হয় খুব স্বল্পক্ষনের দেখা আবার মাঝে মাঝে সেইটুকুও হয়তো হয়না ।
কিন্তু ঠিক যেই ভাবে দুই অভিনেতা দের মধ্যে সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলেছিলেন পরিচালক, তা অভাবনীয়। এক ফেকাসে Colour Pallete যেন সারা ছবি টাকে ঢেকে রেখেছিলো, ঠিক তাদের দূরত্বের মতন। আর সিনেমার শেষে সেই দুজনের কিছুক্ষনের জন্য দেখার দৃশ্য, আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে। সেই দৃশ্য যেন এক স্বপ্নের মতো আমাদের কাছে উঠে আসে, ওদের দেখে দর্শক হয়ে আমাদের-ও মন ভোরে ওঠে আনন্দে, আর পরিচালক হয় আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত হয়ে ছিলেন সফল।
বাকিটা ব্যক্তিগত
(প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য)
প্রেম খোঁজার এবং প্রেম বোঝার আশায় প্রমিত একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রেম নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরির উদ্যোগ নেন। এবং তারপর গল্পে আসে সেই মোহিনী গ্রাম, যেখানে সবাই একে অপরকে ভালোবাসে।
পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের প্রথম এই সিনেমা সারা ফেলেছিলো গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এবং এই সিনেমার হাত ধরে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। মানুষের জীবনে ভালোবাসার মাহাত্ব এবং সেই ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার ধৈর্য কতটা প্রয়োজন একটা আভাস দেয় এই অসাধারণ এক সিনেমা।
গ্রাম টার আক্ষরিক মানে কল্পনা, আর সেটাই আমাদের এই সিনেমা বোঝাতে চায় যে ভালোবাসা এক কল্পনার মতন, আমরা নিজেরা চাইলেও যতক্ষণ না সেটা আমাদের কাছে আসছে, আমরা তা পাবো না। ঠিক যে ভাবে এই মোহিনী গ্রামটাকে তুলে ধরেছেন পরিচালক তা বিস্ময়কর।
আর শেষে এই সিনেমাতে প্রতিটি চরিত্রের মানসিকতা এতো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা দর্শকদের নিজেদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কে প্রশ্ন করবে।
মন্দার
(অনির্বান ভট্টাচার্য)
বাংলার OTT তে একই স্রোতের ধারা পেরিয়ে একটা ওয়েবসিরিজ আসে যা সবাইকে চমকে দিয়েছিলো, নাম মন্দার। বিখ্যাত অভিনেতা অনির্বান ভট্টাচার্যের লেন্স এর পিছনে প্রথম কাজ। এখানে পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য তার এক নিজস্বতা নিয়ে আসেন এই কাজটি তে। যেমন সুন্দর ক্যামেরার কাজ ঠিক তেমনি অসাধারণ এক চিত্রনাট্য, যা Shakespear-এর ‘Macbeth’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অসাধারণ ভাবে গেইলপুরের এক ছোট গ্রামে, গল্প টাকে টাকে প্রাণ দেয়।
এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র একে অপরের থেকে আলাদা, তাদের মনের ভেতরের টানাপোড়েন, লোভ ও লালসা এতো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক এবং তার চিত্রনাট্যকার প্রতীক দত্ত, তাদের সত্যি কুর্নিশ।
এই সব কিছুর মাঝে মনে সবচেয়ে দাগ কেটেছে এই ওয়েবসিরিজ-এর সেই একটা থথমে আবহ যেটা আপনার গায়ে কাটা দিতে বাধ্য।
তাই শেষ-মেশ স্বাদসঙ্গত চিত্রকলার মাধ্যমে “মন্দার” দর্শকের চোখে সুন্দরভাবে বাংলা ভাষার মাধুর্য স্বীকার করে। এই ওয়েবসিরিজটি দেখা নিশ্চয়ই স্বার্থপর।
নগরকীর্তন
(কৌশিক গাঙ্গুলী)
আপনি নতুন ধারার বাংলা সিনেমার কথা বলছেন এবং যদি কৌশিক গাঙ্গুলির সৃষ্টির উল্লেখ না করেন তাহলে তা পাপের সমান। তার অপার সুন্দর সিনেমার ভান্ডার থেকে একটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা সত্যি অসম্ভব, কিন্তু যদি একটা সিনেমা বাঁচতেই হয়ে তাহলে সেটা হবে নগরকীর্তন।
এর গল্পটা খুব সহজে বলতে গেলে দুই ভালোবাসার মানুষের, যারা একে ওপরকে ভালোবাসতে কোনো দ্বিধা করেনা এবং নিজেদের ভালোবাসার জন্য সব কঠিন পরিস্থিতির সামনে রুখে দাঁড়াতে পারে।
শুনে মনে হলে, এই রকম গল্প আগেও শুনেছেন তাই তো?
কিন্তু এবার আসে পরিচালক ও লেখক কৌশিক গাঙ্গুলি। তিনি যে সুন্দর ভাবে সমাজের কাছে ‘Transgender’ দের বিষয়ে নিজের চিন্তা ধারা প্রকাশ করেছেন, এবং তাদের প্রতি সমাজের একটা ‘বিষাক্ত’ মনোভাব ছাড়ানোর প্রচেষ্টা সত্যি অন্যশিকার্য।
কিন্তু সিনেমাতে সাড়া ফেলেছিলেন দুই দক্ষ অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী আর ঋদ্ধি সেন। এই বিষয়ে বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে এই সিনেমাটিতে ঋদ্ধি সেন রিটেইক চক্রবর্তীর মাপের অভিনেতা কে চাপিয়ে গেছে। তার চোখে দুঃখ এবং কষ্ট ঠিক যে ভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন তা সত্যি বহুদিন আপনার মাথায় ঘুরবে।
এই চলচ্চিত্রের গল্পটি আত্ম-সন্ধান এবং প্রেমের উত্তুঙ্গতা সম্বন্ধে অসাধারণ। ‘নগরকীর্তন’ কলকাতা রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা পেয়েছে।